Saturday, 11 November 2017

সংসদের কার্যপ্রণালীতে পয়েন্ট অব অর্ডার কী ?

সংসদের কার্যপ্রণালীতে পয়েন্ট অব অর্ডার কী ?ইংরেজি ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’ বোঝাতে কি কোনো বাংলা শব্দবন্ধ আছে? ইংলিশ অক্সফোর্ড ডিকশনারি এর যা ব্যাখ্যা করেছে তা হল, ‘আনুষ্ঠানিক আলোচনা’ বা ‘আনুষ্ঠানিক বিতর্ক’। কিন্তু আমাদের জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির বরাত দিয়ে ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’ শব্দগুলো যে ক্ষেত্রে ব্যবহূত হয় তা কি আনুষ্ঠানিক আলোচনা বা বিতর্ক?
হাতের কাছে থাকা কানাডার হাউস অব কমন্সের কার্যপ্রণালী বিধি বলছে, হাউস অব কমন্সের কার্যক্রম চলাকালে কোনো সদস্য যদি মনে করেন যে, প্রথাগত বিধিমালার ভুল প্রয়োগ ঘটেছে বা পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে তাহলে কোনো সদস্য তত্ক্ষণাত্ সে ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। এই দৃষ্টি আকর্ষণটাই পয়েন্ট অব অর্ডার। যেকোনো সদস্য পয়েন্ট অব অর্ডারে কোনো অসংসদীয় মন্তব্য, আইনের ব্যত্যয়, পুনরাবৃত্তি বা কোনো ধরনের অসঙ্গতি অধিবেশনের চেয়ারম্যানের দৃষ্টিতে আনতে পারেন। তবে প্রশ্নটি তুলতে হবে ঘটনা বা বিচ্যুতি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে। অধিবেশন যদি অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়, তাহলে আর পয়েন্ট অব অর্ডারে কোনো বক্তব্য উত্থাপনের সুযোগ নেই। পয়েন্ট অব অর্ডার যেহেতু পদ্ধতিগত বিচ্যুতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ, কাজেই স্পিকারের দায়িত্ব সেদিকে নজর দেওয়া এবং বিচ্যুতি সংশোধন করা। (সূত্র : হাউস অব কমন্স প্রসিডিউরস অ্যান্ড প্র্যাকটিসেস)
কয়েক দিন ধরে দেখছি, ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’-এর সূত্রে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও জাতীয় সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম মিডিয়ায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে আলোচনায় আছেন। গত ৪ মার্চ সংসদে দেওয়া বক্তব্য তাকে আবারও আলোচনায় এনেছে। ‘হাতির লাথি সহ্য করা যায়, চামচিকার ভেংচি সহ্য করা যায় না’-আলোচনার জন্য এর চেয়ে সরস উক্তি কি রাজনীতিকরা দিতে পারেন!
মিডিয়ার খবর থেকে জানা গেল, শেখ সেলিম সেদিন সন্ধ্যায় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে যা বলেছেন তা হল-তাকে উদ্দেশ করে দেওয়া বিএনপি নেতাদের কিছু বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্য। তার আগে ২ মার্চ রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে শেখ সেলিম বলেছিলেন, আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যারা করে তাদের হাত-পা কেটে দেওয়া হবে। তার এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় পরদিন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, আন্দোলন স্তব্ধ করতে এ ধরনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। হুমকিদাতারা হয়তো ভুলে গেছেন, এর পরিণতি হয় দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া, নয়তো জনগণের সামনে বিচারের মুখোমুখি হওয়া।
শেখ সেলিমের বক্তব্য এবং তার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি নেতাদের বক্তব্য-কোনোটাকেই রাজনীতির শোভনচর্চার মধ্যে ফেলা যায় না। ফলে এ নিয়ে কথা বলা বৃথা। কিন্তু মেঠো রাজনীতির মেঠো বক্তৃতার জবাব দেওয়ার জন্য যখন সংসদের ফ্লোর ব্যবহূত হয়, তাও আবার বিধি অনুসরণ না করে, তখন সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এই আলোচনা বা বিতর্কের শুরু করেছিলেন শেখ সেলিম। সেই বক্তৃতাটা তিনি করেছিলেন সংসদের বাইরে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে। বিএনপি নেতারা তার জবাব দিয়েছেন তাদের দলীয় অফিসে বসে। কিন্তু শেখ সেলিম তার জবাব দেওয়ার জন্য তার সংসদীয় প্রতিরক্ষা ব্যবহার করে সংসদের ফ্লোরকে ব্যবহার করলেন। আইন এবং নৈতিকতা দুটো প্রশ্নই সমানভাবে সামনে চলে আসে এ ঘটনায়। বিএনপি তো সংসদেই নেই। তারা নির্বাচন বর্জন করায় একতরফা বিতর্কিত নির্বাচনে এটা একটা একতরফা সংসদ। বিএনপি যেমন তাদের দলীয় ফোরামে শেখ সেলিমের বক্তব্যের জবাব দিয়েছে, শেখ সেলিমও তাই করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটাকে সংসদে টেনে নিয়ে এসেছেন।
কিন্তু শেখ সেলিমের এই বক্তব্য ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’ হয় কীভাবে? বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ইংরেজি সংস্করণে ৩০১ অনুচ্ছেদে ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’ পাওয়া যায়। কার্যপ্রণালীর ৩০১ অনুচ্ছেদ ধরে বাংলা সংস্করণে পাওয়া যায় ‘বৈধতার প্রশ্ন’। ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’-এর বাংলা অর্থ তাহলে ‘বৈধতার প্রশ্ন’। অন্তত জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি অনুসারে।
সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’ বা ‘বৈধতার প্রশ্ন’ সম্পর্কে কী বলছে? ‘অনুচ্ছেদ ৩০১ : বৈধতার প্রশ্ন ও তত্সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত’ শিরোনামে উপ-ধারায় বলা হয়েছে :
‘(১) কোনো বৈধতার প্রশ্নকে এই বিধিসমূহের ও সংসদের কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণকারী সংবিধানের অনুচ্ছেসমূহের ব্যাখ্যা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে এবং স্পিকারের ক্ষমতার আওতাভুক্ত বিষয় হইতে হইবে।
(২) কেবল সংশ্লিষ্ট সময়ে সংসদের বিবেচনাধীন বিষয়ের ওপর বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইতে পারে।
(৩) তবে শর্ত থাকে যে, কোনো বৈধতার প্রশ্ন যদি সংসদের শৃঙ্খলা রক্ষা বা সংসদের কাজের ব্যবস্থাপনার সহিত সম্বন্ধযুক্ত হয়, তাহা হইলে স্পিকার কোনো সদস্যকে কার্যসূচির এক দফা শেষ হওয়া ও অন্য দফা আরম্ভ হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে অনুরূপ বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপনের অনুমতি দিতে পারিবেন।’
শেখ সেলিম যে বিষয়ে ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’-এ বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে ওই সময় সংসদে কোনো আলোচনা চলছিল না। বিষয়টি স্পিকারের ক্ষমতার আওতাভুক্ত বিষয়ও নয়। তাহলে ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’-এ তিনি এ বক্তব্য দিলেন কীভাবে?
একই অনুচ্ছেদের চতুর্থ উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই বিধির ২ ও ৩ উপ-বিধির বিধানসাপেক্ষে কোনো সংসদ সদস্য বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করিতে পারিবেন এবং কোনো প্রশ্ন বৈধতার প্রশ্ন কি না; স্পিকার তাহা নির্ধারণ করিবেন এবং বৈধতার প্রশ্ন বলিয়া নির্ধারিত হইলে স্পিকার তাহার উপর যে সিদ্ধান্ত প্রদান করিবেন, তাহা চূড়ান্ত বলিয়া গণ্য হইবে।’
প্রশ্ন হচ্ছে, জাতীয় সংসদের স্পিকার কি শেখ সেলিমের বক্তব্যকে ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’-এ বক্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করেছেন? করে থাকলে কোন বিবেচনায়? শেখ সেলিম সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা-এই বিবেচনায়? এই অনুচ্ছেদের পঞ্চম উপ-ধারা কিন্তু বলছে, ‘বৈধতার প্রশ্ন বিশেষ অধিকারের প্রশ্ন নহে।’ অর্থাত্ এটা শেখ সেলিমের বিশেষ অধিকারও নয়।
কার্যপ্রণালী বিধি (অনুচ্ছেদ ৩০১-এর ৬ উপ-ধারা) বলছে, ‘কোনো সদস্য
(ক) তথ্য জানিবার জন্য কিংবা
(খ) স্বীয় বক্তব্য ব্যাখ্যার জন্য কিংবা
(গ) সংসদে কোনো প্রস্তাব ভোটে দিবার সময় কিংবা
(ঘ) অনুমানসিদ্ধ বিষয় লইয়া, কিংবা
(ঙ) বিভক্তি ভোটের ঘণ্টা বাজে নাই বা শোনা যায় নাই বলিয়া কোনো বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করিবে না।’
শেখ সেলিম স্বীয় বক্তব্য ব্যাখ্যার জন্য পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্য দিয়েছেন, যা চতুর্থ উপ-ধারার (খ)-কে লঙ্ঘন করে।
পয়েন্ট অব অর্ডারের সংজ্ঞায় পড়ে না, এমন কোনো বিষয় কি কোনো সংসদ সদস্য উত্থাপন করতে পারেন না? অবশ্যই পারেন। অনুচ্ছেদ ৩০২-এ ‘বৈধতার প্রশ্ন নয় এমন বিষয় উত্থাপন’ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেওয়া হয়েছে। বিধি বলছে, ‘কোনো সদস্য বৈধতার প্রশ্নবহির্ভূত যে কোনো বিষয় সংসদের গোচরে আনিতে চাহিলে তিনি সচিবের নিকট সংসদে উত্থাপনীয় বিষয়টির সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং অনুরূপ ইচ্ছার কারণ বিবৃত করিয়া লিখিতভাবে নোটিশ প্রদান করিবেন এবং স্পিকার সম্মতি দিলে স্পিকার কর্তৃক নির্ধারিত তারিখ ও সময়মতো তিনি বিষয়টি উত্থাপন করিতে পারিবেন।’
শেখ সেলিম কি সংসদে বক্তব্য দেওয়ার আগ্রহ জানিয়ে লিখিত নোটিস দিয়েছিলেন?
জাতীয় সংসদ জাতীয় বিষয় নিয়ে খুবই কম সময় ব্যয় করে-এমন একটা কথা বিভিন্ন সময়ে শোনা যায়। নতুন মন্ত্রী-এমপি হয়ে আসা রাজনীতিকরা সংসদকে ঠিক সংসদের মতো ব্যবহার করেন না। প্রবীণ রাজনীতিকরাও মাঝেমধ্যে এমনসব কথাবার্তা বলেন যে, পুরো জাতি লজ্জিত হয়। সেগুলো নিয়ন্ত্রণের কোনো পথ হয়তো নেই। কিন্তু মন্ত্রী-এমপিরা অন্তত কার্যপ্রণালী বিধি যথাযথ অনুসরণ করছেন কি না সেটি তো নিশ্চিত করা যায়! নাকি যায় না?

No comments:

Post a Comment

বিদেশ থেকে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া

এই জন্য অন্তত ১ দিনের জন্য হলেও  husband k বাংলাদেশে আসতে হবে বাংলাদেশে এসে  কাজী অথবা একজন আইনজীবীর কাছে যেতে হবে, সেখানে গিয়ে  তার স্ত্...